৫১। সূরা যারিয়াত, আয়াত ৩১ থেকে ৬০

কওমে লূত, ফিরআউন, আদ, সামূদ এবং কওমে নূহের অবাধ্যতা, বর্তমানের কাফিরদের সাথে তাদের সাদৃশ্য ও পরিণাম বর্ণিত হয়েছে।

আসমান-জমিন এবং জোড়ায় জোড়ায় বস্তু সৃষ্টিকারী এক আল্লাহর ইবাদাত করতে এবং তাঁর সাথে শরীক না করতে হুকুম করা হয়।

পূর্বের ও বর্তমানের কাফিররা নিজ নিজ যুগের নবীদের উন্মাদ, যাদুকর ইত্যাদি অপবাদ দেয়। এদের সকলেরই শাস্তির পালা এসেছে বা আসবে।

জ্বীন ও মানুষকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ আমাদের কাছে রিয্ক চান না, তিনি নিজেই রিয্কদাতা।

৫২। সূরা তূর

সূরা তূরে বিভিন্ন বস্তুর কসম করে আসন্ন অবশ্যম্ভাবী আযাবের কথা নিশ্চিত করা হয়েছে। কাফিরদের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। জান্নাতে মুত্তাকী এবং তাদের অনুগামী সন্তান সন্ততির মধুর পুনর্মিলন, বাসস্থান, পানাহার, বসার জায়গা, সঙ্গী ও খুনসুটির বর্ণনা দেওয়া হয়। পৃথিবীর ভয়ের জীবন থেকে এই নিরাপদ জীবনে আনায় তারা আল্লাহর শোকরগুজার হবে।

কাফিররা রাসূল (সাঃ)-কে কবি বলে যে অপবাদ দিত, সে ব্যাপারে তাদের বুদ্ধিমত্তার কাছেই প্রশ্ন রাখা হয়েছে। কারণ স্বভাষী হিসেবে তারা স্পষ্টতই বুঝতে পারছিল কবিদের স্বরচিত কথাবার্তা এরকম হয় না। কাফিরদের নানাবিধ অক্ষমতার কথা একে একে উল্লেখ করার পাশাপাশি আল্লাহর বড়ত্বকে স্পষ্ট করা হয়। ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা, আর তাদের নিজেদের পছন্দ পুত্রসন্তান- এরকম হাস্যকর আকিদাকে তিরস্কার করা হয়। মু’জিযা দেখার আবদার করলেও এরা যে সেগুলোকে প্রাকৃতিক কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে এড়িয়ে যাবে, তা উল্লেখ করা হয়। আসন্ন আযাবের অপেক্ষায় তাদেরকে ছেড়ে দিতে বলা হয়। ইবাদাত ও তাসবীহ পাঠ করে আত্মিক শক্তি লাভ করার নিয়ম জানানো হয়, যাতে এসব যন্ত্রণা মোকাবেলা সহজ হয়।

৫৩। সূরা নাজম

সূরা নাজমে নক্ষত্রের (যা দেখে মানুষ পথ চেনে) কসম করে বলা হয়েছে রাসূল (সাঃ) পথভ্রষ্ট নন। জিবরীল (আঃ) তাঁর নিকট ওয়াহী নিয়ে আসার দৃশ্য বর্ণিত হয়। জীবরীলকে রাসূল (সাঃ) দু’বার তাঁর প্রকৃত আকৃতিতে দেখেছেন। একবার ওয়াহী আনার সময়, আরেকবার মিরাজে সিদরাতুল মুনতাহা নামক কুল গাছের নিকটে। এছাড়াও মিরাজের রাতে রাসূলকে (সাঃ) আরও অনেক বড় বড় নিদর্শন দেখানো হয়েছে।

লাত, মানাত, উযযা দেবীকে কাফিররা আল্লাহর কন্যা বলত। তাদের এ শির্কি বিশ্বাস খণ্ডন করে বলা হয় এগুলো অস্তিত্বহীন সত্ত্বা, তাদের বাপদাদার রাখা কাল্পনিক কিছু নাম মাত্র। ফেরেশতাদেরও তারা কল্পিত মেয়েলি নামে ডাকে। দেবদেবীদের তারা আল্লাহর নিকট সুপারিশকারী ভাবে, অথচ সম্মানিত ফেরেশতারাও এরকম সুপারিশের অধিকার রাখেন না।

দুনিয়ার জীবনকে সবকিছু মনে করা ব্যক্তিদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা দেখানো হয়েছে। কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা, কদাচিৎ ভুল করা মুমিনদের ক্ষমার ঘোষণা দেওয়া হয়। আত্মপ্রশংসা করতে নিষেধ করা হয়।

মানুষ যা চায় তা-ই পাবে না। সে যা কর্মপ্রচেষ্টা করবে, তার প্রতিদানই পাবে। আখিরাতে সব কাজের প্রতিফল দিয়ে দেওয়া হবে।

হাসি-কান্নার উপলক্ষ দান, জীবন-মৃত্যু দান, তুচ্ছ পানি হতে নারী-পুরুষ সৃষ্টি, পূর্বেকার অবাধ্য জাতিসমূহের ধ্বংস আল্লাহই ঘটান। একদল কাফির শি'রা নামক এক বিশাল নক্ষত্রের পূজা করে, সেই নক্ষত্রের মাবুদও আল্লাহ। অতএব হাসিঠাট্টা ও অহংকার ত্যাগ করে আল্লাহর আযাবের ভয় ও দয়ার আশায় ক্রন্দন এবং সেজদা করতে হবে।

৫৪। সূরা ক্বমার

সূরা ক্বমারের শুরুতে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করার মু’জিযার কথা উল্লেখ করা হয়। এর সংঘটন কিয়ামাত নিকটবর্তী হওয়ার আলামত। তা দেখেও কাফিরদের ঈমান না আনাকে তিরস্কার করা হয়। এর আগেও কিতাবের জ্ঞানগর্ভ বাণী শুনেও তারা কুফরে অটল থেকেছে। কিয়ামাত দিবসের ভয়াবহতা দেখে তারা বিমূঢ় হয়ে যাবে।

কওমে নূহ, আদ, সামূদ, কওমে লূত ও ফিরআউনের অবাধ্যতা ও পরিণাম বর্ণিত হয়। মু’জিযা দেখেও তারা কীভাবে কুফরি করত, তা বলা হয়। এখনকার কাফিররা তো তাদেরই একটা দল, শক্তিতেও তাদের চেয়ে কম। এদের জন্য দুনিয়ার আযাব তো আছেই, সেই সাথে আছে আখিরাতের ভয়াবহতা। আল্লাহ কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। অতএব আছে কি কেউ উপদেশ গ্রহণ করার?

৫৫। সূরা আর-রহমান

সূরা আর-রহমানে জ্বীন ও মানুষের প্রতি দয়াময় আল্লাহর বিবিধ নিয়ামাতের কথা স্মরণ করানো হয়েছে যেগুলো অস্বীকারের উপায় নেই। কুরআন শিক্ষা দান, মাটি থেকে মানুষ ও আগুন থেকে জ্বীন সৃষ্টি, ভাবপ্রকাশের ক্ষমতা, চাঁদ, সূর্য, বৃক্ষ, আকাশ, জমিন, ফলমূল, ফসল, উদয়াচল, অস্তাচল, সাগরতলের দ্রব্যাদি ও তাতে চলমান যান।

আল্লাহ ছাড়া এ সবই ধ্বংস হবে। মানুষ ও জ্বীন এই দুই ওজনদার সৃষ্টিকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। কিয়ামাত সংঘটন জাহান্নামের ভেতর কাফিরদের ছুটোছুটির ভয়াল চিত্র আঁকা হয়।

মুত্তাকীদের জন্য জান্নাতে রাখা একাধিক উদ্যান, প্রস্রবণ, এগুলোতে বিদ্যমান ফলমূল, কার্পেট, বসার জায়গা এবং পূর্বে কেউ স্পর্শ করেনি এমন পবিত্র সঙ্গীর বর্ণনা দেওয়া হয়।

৫৬। সূরা ওয়াক্বিয়া

সূরা ওয়াক্বিয়া'য় বলা হয় অবশ্যম্ভাবী কিয়ামাত সবকিছুকে উঁচুনিচু করে দেবে, দুনিয়ার অহংকারীরা নীচু হয়ে যাবে, অবহেলিত মুমিনরা উঁচু মর্যাদার হবে। বিচারের পর সকলে তিন দলে ভাগ হবে- ডান হাতের দল, বাম হাতের দল ও অগ্রগামী দল।

অগ্রগামীরা তাকওয়ার উঁচু পর্যায়ের লোক। তাঁদের অধিকাংশ হবেন পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে, অল্পসংখ্যক পরবর্তীদের থেকে। তাঁদের পাওনা জান্নাতের বাগান, প্রস্রবণ, ফলমূল, গোশত, পানপাত্র, পানীয়, চিরকিশোর পরিচারক, বসার জায়গা, হুর ইত্যাদির বর্ণনা দেওয়া হয়।

ডান হাতে আমলনামা পাওয়া ব্যক্তিরাও নেককার। তাঁদের অনেকে পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে, অনেকে পরবর্তীদের মধ্য হতে। তাঁদের জান্নাতেরও বর্ণনা দেয়া হয়। নবযৌবনশীলা কুমারী প্রেমময়ী নারীদের কথা বলা হয়, যা দ্বারা দুনিয়ার নেককার নারীও বোঝানো হতে পারে, হুরও বোঝানো হতে পারে।

বাম হাতে আমলনামা প্রাপ্তরা হলো কাফিররা। তাদের প্রাপ্য জাহান্নামী কাঁটাদার গাছ ও তপ্ত পানির বর্ণনা দেওয়া হয়।

মানুষের জন্ম-মৃত্যু, ফসল উদগমন, বারিপাত সবই আল্লাহর হুকুমের অধীন। তিনি দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করে আখিরাত কায়েম করতে পারবেন না- এটা কেমন করে কেউ বিশ্বাস করতে পারে?

জ্যোতিষীরা খবরাদি পায় নাপাক জ্বীনশয়তানদের কাছ থেকে। অথচ কুরআন নিয়ে আসেন পবিত্র ফেরেশতাগণ। এতে বর্ণিত আখিরাত সত্য। সেদিন ডানদল, বামদল, অগ্রগামী দল সবাই নিজ নিজ প্রতিদান পাবে।

৫৭। সূরা হাদীদ

সূরা হাদীদ নাযিল হয় মক্কা বিজয় করে রাষ্ট্র ক্ষমতা অধিকার করে মুসলিমদের শক্তিশালী অবস্থা চলে আসার পর। মুসলিমদেরকে দুনিয়াবিমুখ করতে আল্লাহপ্রদত্ত সম্পদ থেকে দানসদকা করার হুকুম করা হয়। এগুলো তো আল্লাহরই দেওয়া সম্পদ, তাই দান করতে কার্পণ্য করা অনুচিত। দানসদকা হলো আল্লাহকে প্রদত্ত উত্তম ঋণ, যার যথাযথ প্রতিদান তিনি দিবেন।

কিয়ামাতের দিন মুমিন নারীপুরুষদের নূর দেওয়া হবে, যা দিয়ে তারা পথ চলবে। মুনাফিকরা সেই আলো দিয়ে পথ চলতে চাইবে। কিন্তু তাদের মাঝে অন্তরাল সৃষ্টি করে মুমিনদের রহমতে রাখা হবে আর মুনাফিকদের আযাব দেয়া হবে।

মুমিনদেরকে দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত থাকতে বলা হয়। দুনিয়ার ভোগবিলাস তো সবুজ থেকে হলুদ হয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ফসলের মতো যার জৌলুস অস্থায়ী। আর দুনিয়ায় যা বিপদআপদ আসে, তা আমাদের সৃষ্টির আগেই তাকদিরে লেখা ছিল। তাই ভালো কিছু পেয়ে আত্মহারা হওয়া যাবে না, বিপদে পড়লে একেবারে ভেঙে পড়া যাবে না। আল্লাহর রাস্তায় দানসদকা করতে হবে। কৃপণ ও কৃপণতায় উৎসাহদাতা অহংকারীদের আল্লাহ পছন্দ করেন না।

আল্লাহ রাসূল ও কিতাব পাঠানোর পাশাপাশি তুলাদণ্ড ও লোহা নাযিল করেছেন। যাতে মুমিনরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে এবং ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে। খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীরা বৈরাগ্যবাদী জীবনযাপন করে আল্লাহকে খুশি করতে চাইত। কিন্তু এভাবে সাংসারিক দায়িত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আল্লাহর হুকুম নয়।