৫৮। সূরা মুজাদালাহ

সূরা মুজাদালাহ'র শুরুতে জাহিলি যুগের একটি তালাক রীতি 'যিহার' এর অসারতা এবং যিহার করে ফেললে এর কাফফারার বিধান আলোচিত হয়।

কাফির-মুনাফিকরা মুসলিমদের সাথে শান্তিচুক্তির পরও নিজেদের মাঝে কানাকানি করে ষড়যন্ত্র করত। আল্লাহ তা উন্মোচন করে দেন। মুসলিমদের নিজেদের মাঝে কানাকানি করে কথা বলা সংক্রান্ত আদব-শিষ্টাচার বর্ণিত হয়েছে।

মজলিসে বসা, অন্যদের জায়গা করে দেয়া, আমিরের নির্দেশে প্রয়োজনে একজন উঠে গিয়ে আরেকজনকে বসানো সংক্রান্ত বিধান বর্ণিত হয়েছে।

মুনাফিকরা রাসূল (সাঃ) এর সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলার নাম করে তাঁর সময়ক্ষেপণ করত। এভাবে সময় চাওয়ার আগে সদকা করার হুকুম করা হয়। ফলে সাহাবাগণ তো তা পালন করেন, মুনাফিকরা খরচের ভয়ে রাসূলের সময় নষ্ট করা ছেড়ে দেয়।

মুনাফিকরা কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব রাখে। তারা এ দলেরও নয়, সে দলেরও নয়। এদেরকে বলা হয়েছে হিযবুশ শয়তান বা শয়তানের দল। আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধাচারী যদি পিতা, পুত্র বা ভাইও হয়, তবুও মুমিনরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখেন না। এঁরা আল্লাহর দল বা হিযবুল্লাহ।

৫৯। সূরা হাশর

সূরা হাশর নাযিল হয় ইহুদী গোত্র বনু নাযিরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। শান্তিচুক্তি সত্ত্বেও তারা রাসূলকে (সাঃ) হত্যাচেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তাদেরকে মদীনা থেকে নির্বাসনে যেতে আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। মুনাফিকদের সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে ডেডলাইনের পরও তারা রয়ে যায়। মুসলিমরা তাদের দূর্গ অবরোধ করে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। অবরোধের উদ্দেশ্যে মুসলিমরা কিছু গাছ কাটেন। অনেকে ভেবেছিলেন কাজটা ঠিক হয়নি। আল্লাহ জানিয়ে দেন এমন প্রয়োজনের মুহূর্তে গাছ কাটা দোষের নয়। এছাড়া বনু নাযিরের ফেলে যাওয়া সম্পদ ফাই হিসেবে মুসলিমদের হস্তগত হয়। জিহাদ করে অর্জিত হয় গনিমত, আর আক্রমণ ছাড়াই হস্তগত সম্পদ ফাই। ফাই বণ্টনের বিধান বর্ণিত হয়।

মুনাফিকদের স্বভাব উন্মোচন করা হয়। তারা বনু নাযিরকে আশ্বস্ত করেছিল মুসলিমরা আক্রমণ করলে তারা প্রতিরোধ করবে বলে। কিন্তু শেষে কোনো সাহায্য করেনি। এরা অত্যন্ত ভীতু একটা জাতি। শয়তান যেভাবে মানুষকে দুনিয়াবি লোভ দেখিয়ে কাফির বানিয়ে তাদের ছেড়ে চলে যায়, মুনাফিকরাও এমন। এদের বাইরে থেকে দেখতে মনে হয় ঐক্যবদ্ধ, আসলে তাদের নিজেদের মাঝে অনেক বিরোধ। আখিরাতে এরা কাফিরদের সাথে জাহান্নামি হবে।

মুমিনদের উচিত আল্লাহকে ভয় করে, তাঁর আদেশ নিষেধ মেনে চলা এবং পরকালের জন্য কী সঞ্চয় পাঠাচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা করা।

শেষ তিন আয়াতে আল্লাহর অনেকগুলো গুণবাচক নাম উল্লেখ করে শেষ হয় এ সূরাটি।

৬০। সূরা মুমতাহিনা

সূরা মুমতাহিনা নাযিল হয় হুদায়বিয়া সন্ধি ও মক্কা বিজয়ের মাঝামাঝি সময়ে। কাফিররা ততদিনে সন্ধি ভেঙে ফেলেছে আর রাসূল (সাঃ) মক্কা আক্রমণের গোপন প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মক্কার এক গায়িকা ইসলাম গ্রহণ না করে মদীনায় এসে আর্থিক সাহায্য চায়। কারণ মক্কায় এখন আর গানের আসর জমার অবস্থা নেই। রাসূল (সাঃ) তাকে সাহায্য দিয়ে বিদায় করেন। বদর যুদ্ধে অংশ নেওয়া এক সাহাবি হাতিব (রাঃ)। তিনি ইয়ামান থেকে মক্কায় এসেছিলেন, পরে মদীনায় হিজরত করেন। কিন্তু তাঁর পরিবার রয়ে যায় মক্কায়। অন্য সাহাবাদের যেসব আত্মীয় মক্কায় রয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের ভরসা ছিল যে আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে কুরাইশ কাফিররা তাঁদের আত্মীয়দের ক্ষতি করবে না। হাতিবের (রাঃ) সেই সুবিধা ছিল না। তিনি ভাবলেন আল্লাহ তো মক্কা বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েই দিয়েছেন। এখন তিনি যদি সেই গায়িকার হাতে চিঠি দিয়ে মক্কাবাসীদেরকে আক্রমণের খবর জানিয়ে দেন, তাহলে তাঁরা হয়তো তাঁর আত্মীয়দের ক্ষতি করবে না। আল্লাহ ওয়াহী নাযিল করে জানিয়ে দেন সেই নারী চিঠি নিয়ে কোথায় পৌঁছেছে। তাকে ধাওয়া করে চিঠি ছিনিয়ে নেয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর হাতিব (রাঃ) স্বীকার করেন। তাঁকে আল্লাহ মাফ করে দেন।

সেইসাথে যুদ্ধরত কাফিরদের সাথে এরকম বন্ধুত্বের ভয়াবহতা আলোচিত হয়। ইবরাহীম (আঃ) কীভাবে তাঁর কাফির আত্মীয়দের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও শত্রুতা ঘোষণা করেছিলেন, তা বর্ণিত হয়। এই আদর্শ অনুসরণ করলে আশা করা যায় কিছু কাফিরকে ঈমান আনিয়ে আল্লাহ মুমিনদের বন্ধু বানিয়ে দিবেন। আর যেসব কাফির যুদ্ধরত নয়, তাদের সাথে সদাচারের অনুমতি দেয়া হয়।

হুদায়বিয়ার একটি শর্ত ছিলো কোনো ব্যক্তি মক্কা থেকে মদীনায় গেলে তাকে মক্কায় ফিরিয়ে দিতে হবে। নারীরা এ শর্তের আওতার বাইরে। তাদের কেউ ঈমান আনার দাবি করে মদীনায় আসলে তাদের যাচাই করা, কাফির স্বামীর সাথে মুমিন নারীর বিবাহবিচ্ছেদের বিধান জানানো হয়। এছাড়া কাফির নারীদের সাথে মুসলিম পুরুষদের যেসব বিবাহ বহাল ছিল, সেগুলো বাতিল ঘোষিত হয়।

৬১। সূরা সফ

সূরা সফ এর শুরুতে কথা ও কাজে মিল রাখার গুরুত্ব আলোচিত হয়।

আল্লাহর রাস্তায় সীসাঢালা প্রাচীরের মতো জিহাদ করার ফযিলত বর্ণিত হয়। জানমাল দিয়ে জিহাদ করা এমন এক ব্যবসা, যা দ্বারা মাগফিরাত পাওয়া যায়, আখিরাতের আযাব থেকে বাঁচা যায়।

বনী ইসরাইলীরা মূসা (আঃ) এর সাথে যে দুর্ব্যবহার করত, তার ফলে আল্লাহ তাদের অন্তর বক্র করে দেন। ফলে পরবর্তী নবীর ওপর তারা ঈমান আনতে পারেনি।

কাফিররা ফুঁ দিয়ে আল্লাহর নূর নিভিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূরকে উদ্ভাসিত করবেন।

ঈসা (আঃ) তাঁর হাওয়ারী (সাহাবি)-গণকে জিজ্ঞেস করেন কারা আল্লাহর রাস্তায় সাহায্যকারী হবে। তাঁরা আনসারুল্লাহ (আল্লাহর রাস্তায় সাহায্যকারী) হওয়ার ওয়াদা করেন। এ ঘটনা বলে মুমিনদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়। কাফিররা অপছন্দ করলেও আল্লাহ এ দ্বীনকে বিজয়ী করে ছাড়বেন।

৬২। সূরা জুমুআহ

সুরা জুমুআতে রাসূল (সাঃ) এর আগমনের হিকমত এবং সমগ্র মানবজাতির উপর তাঁর নবুওয়তের কথা বলা হয়। কিতাবের জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও যেসব ইহুদী খ্রিষ্টান ঈমান আনছে না, তাদেরকে কিতাব বহনকারী গাধার সাথে তুলনা করা হয়।

ইহুদীরাই আল্লাহর প্রিয়বান্দা হলে নিজেদের মৃত্যু কামনা করে দেখাক। কিন্তু নিজেদের কুফরির ব্যাপারে জানা থাকায় তা তারা করবে না।

জুমুআর সালাতে দ্রুত আসা এবং খুতবার সময় অন্য কাজে ব্যস্ত না থেকে মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনার হুকুম করা হয়।

৬৩। সূরা মুনাফিকুন

সূরা মুনাফিকুনে মুনাফিকদের স্বভাব বর্ণিত হয়। তারা ঈমান আনার মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়। ঠেকনা/ঠেস দেওয়া কাঠের মতো অন্যের ওপর নির্ভর করে। যেকোনো কোলাহলকে নিজেদের বিরুদ্ধে মনে করে। তাদের কথা খুব আকর্ষণীয় মনে হয়।

বনু মুস্তালিক যুদ্ধ জয়ের পর কুয়া থেকে পানি তোলা নিয়ে বিরোধের জের ধরে মুহাজির-আনসার হাতাহাতি লাগার উপক্রম হয়। রাসূল (সাঃ) তা মিটিয়ে দেন। গনিমতের লোভে জিহাদে আসা মুনাফিকরা এ সুযোগ নিয়ে আনসারদের ভেতর জাতিয়তাবাদী চেতনা উস্কে দিতে চেষ্টা করে। সাহাবি যায়দ বিন আরকাম (রাঃ) তা রাসূল (সাঃ)-কে জানিয়ে দেন। তিনি (সাঃ) জিজ্ঞাসাবাদ করলে মুনাফিকরা জোরেশোরে অস্বীকার করে। আল্লাহ আয়াত নাযিল করে অভিযোগের সত্যতা জানিয়ে দিয়ে মুনাফিকদের তিরস্কার করেন।

হায়াত বাকি থাকতেই নেক আমল ও দানসদকা করার জন্য বলা হয়। সন্তানসন্ততি ও সম্পদের টানে পড়ে কেউ যেন দ্বীন থেকে গাফেল না হয়।

৬৪। সূরা তাগাবুন

সূরা তাগাবুনের শুরুতে সৃষ্টিজগতে আল্লাহর সর্বব্যাপী জ্ঞান ও ক্ষমতার বর্ণনা এবং পূর্ববর্তী জাতিসমূহের অবাধ্যতার কথা বলে কিয়ামাতের সত্যতা ঘোষিত হয়। সেদিন একদল লোক আরেকদলকে দেখে আক্ষেপ করবে।

কোনো বিপদআপদ আল্লাহর হুকুম ছাড়া আসে না, তাই ধৈর্য ধরে দ্বীনের ওপর থাকতে হবে।

পরিবার পরিজন হলো পরীক্ষাস্বরূপ। তারা যদি আল্লাহর নাফরমানি করতে উদ্বুদ্ধ করে, তাহলে তারা শত্রুর মতো। তবে তাওবাহ করে শুধরে গেলে ভিন্ন কথা।

আল্লাহর রাস্তায় দানসদকায় উৎসাহিত করে একে উত্তম ঋণ বলা হয়, যা আল্লাহ বহুগুণ বাড়িয়ে ফেরত দেবেন।

৬৫। সূরা ত্বালাক

সূরা ত্বালাকের বিষয়বস্তু হলো তালাক, ইদ্দত, ইদ্দতকালীন স্বামীর ঘরে থাকা, ঈদ্দতকারিণীর ভরণপোষণ, স্বামী গরীব হলে সেক্ষেত্রে ভরণপোষণের নিয়ম, সাক্ষী রাখা, সত্য সাক্ষ্য দেওয়া ইত্যাদি হুকুম আহকাম। সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করতে বলা হয়। তাহলে আল্লাহ সমাধানের পথ খুলে দেবেন এবং ধারণাতীত উৎস থেকে রিযক দেবেন।

৬৬। সূরা তাহরীম

সূরা তাহরীম নাযিল হয় রাসূল (সাঃ) এর একটি কসমের ভিত্তিতে। রাসূল (সাঃ) স্ত্রীদের ঘরে ঘরে যাচ্ছিলেন। যায়নাব (রাঃ) তাঁকে এক জাতের মধু খেতে দেন। পরে তিনি আয়িশা (রাঃ) ও হাফসা (রাঃ) এর ঘরে গেলে দুজনই তাঁর মুখ থেকে দুর্গন্ধ আসার কথা বলেন। রাসূলের (সাঃ) দুর্গন্ধ খুব অপছন্দের। তিনি আর কখনো মধু না খাওয়ার কসম করেন। এটা যেন আর কাউকে না জানানো হয়, তা বলে দেন। কারণ যায়নাব (রাঃ) জানলে কষ্ট পাবেন। কিন্তু হাফসা (রাঃ) এটি আয়িশা (রাঃ)-কে বলে দেন। এই বলে দেওয়ার ঘটনা আবার রাসূল (সাঃ) জানতে পারেন। কিন্তু হাফসা (রাঃ) লজ্জা পাবেন বলে চুপ থাকেন।

আল্লাহ আয়াত নাযিল করে রাসূলকে (সাঃ) সেই অপ্রয়োজনীয় কসমের কাফফারা আদায় করতে বলেন। আর নবীপত্নীদেরকে নসিহত করেন। মুমিনদেরকে পরিবার পরিজন মিলে ইবাদাত করে সকলে জাহান্নাম থেকে বাঁচতে বলা হয়। এ মর্মে কয়েকজন নারীর কথা বলা হয়, যারা বিভিন্নরকম। একদিকে লূত (আঃ) ও নূহ (আঃ) এর স্ত্রীদ্বয়, যারা ছিলো নেক লোকের পাপাচারী স্ত্রী। আরেকদিকে আসিয়া (আঃ) যিনি ছিলেন পাপাচারী লোকের নেক স্ত্রী। আর মারইয়াম (আঃ) যিনি সতীত্ব রক্ষা করেন এবং অলৌকিকভাবে ঈসা (আঃ) এর মা হন।