২৫। সূরা ফুরক্বান, আয়াত ২১ থেকে ৭৭
কাফিররা চায় আল্লাহ নিজে অথবা ফেরেশতা এসে যেন তাদের ঈমান আনতে বলে। কিন্তু এ ঘটনা যেদিন সত্যিই ঘটবে, তারা হাত কামড়াবে আর চাইবে এমনটা যেন না ঘটে। কিয়ামাতের দিন এক মেঘে আল্লাহ আসবেন (যেভাবে 'আসা'টা তাঁর শানের উপযোগী, সেভাবে। এই 'আসা'র স্বরূপ প্রকৃতি আমাদের অজানা) আর সকল আসমানের ফেরেশতারা আসবেন এবং বিচার শুরু হবে। কাফিররা হা-হুতাশ করবে, হায় আমি যদি নবীকে মানতাম, যদি অমুককে বন্ধু না বানাতাম!
শয়তান এমন এক বন্ধু যে দরকারের সময় ছেড়ে যায়। নবীগণ কাফিরদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবেন।
কুরআনকে অল্প অল্প করে নাযিল করার হিকমাহ বর্ণিত হয়।
পূর্বেকার কিছু জাতির নাফরমানির পরিণতি সংক্ষেপে বলা হয়। আযাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত কিছু জনপদের উপর দিয়ে মক্কাবাসীদের চলাফেরা করা লাগে। তবু এসব নিদর্শন তাদের মনে আল্লাহভীতি জাগায় না।
কাফিরদের কুফরির কারণে রাসূল (সাঃ)-কে অতিরিক্ত মনোঃকষ্ট পেতে নিষেধ করা হয়। এরা চতুষ্পদ জন্তুরও অধম।
মানুষের প্রতি আল্লাহর বিভিন্ন নিয়ামাত সূর্যের আবর্তন, দিন-রাত, রোদ-ছায়া, বৃষ্টিবাহী বায়ু, পানিচক্র, মিঠা ও লোনা পানির মাঝে অদৃশ্য আড়াল ইত্যাদির কথা স্মরণ করানো হয়েছে।
রাসূল (সাঃ) সুসংবাদদতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। তিনি কোনো পার্থিব প্রতিদান চান না।
কাফিররা আল্লাহকে স্বীকার করে। কিন্তু তাঁর সিফাতি নামগুলো অস্বীকার করে। 'রহমান' নাম উল্লেখ করলে তারা আপত্তি জানায়।
রহমানের বান্দাদের কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়- নম্র চলাফেরা, অজ্ঞদের সাথে তর্ক না করা, সালাত আদায়, দু’আ করা, অপব্যয় ও কৃপণতার মাঝামাঝি পথ অবলম্বন করা, শির্ক না করা, অন্যায় হত্যা না করা, ব্যভিচার না করা, অন্যায় কাজে না জড়ানো, অর্থহীন কাজকারবার থেকে গাম্ভীর্য বজায় রেখে সরে আসা, রবের নির্দেশ মন দিয়ে শোনা, নেককার জীবনসঙ্গী ও সন্তানের জন্য দু’আ করা, মুত্তাকীদের নেতা হতে দু’আ করা। এরা জান্নাতে সুউচ্চ প্রাসাদের অধিকারী হবে।
বান্দারা আল্লাহর ইবাদাত না করলে আল্লাহর কোনো ক্ষতি নেই, বান্দারই ক্ষতি।
২৬। সূরা শু’আরা
কাফিররা নিত্যনতুন মু’জিযা দেখার দাবি জানায়। পূর্বেকার উম্মতরা কীভাবে মু’জিযা অস্বীকার করে ধ্বংস হয়েছে আর সৃষ্টিজগতে ছড়ানো নিদর্শন দেখেই কীভাবে ঈমান আনা যায়, তা বর্ণিত হয়েছে সূরা শু’আরায়।
মূসা (আঃ) নবুওয়ত পেয়ে কথার জড়তা কাটানোর দু’আ করেন, হারুন (আঃ)-কেও নবুওয়ত দিয়ে তাঁর উজির বানানো হয়। তাঁরা ফিরআউনের কাছে গিয়ে তাওহীদের দাওয়াত দেন এবং বনী ইসরাইলকে মুক্তি দিতে বলেন। ফিরআউন মূসাকে লালনপালন করা ও তাঁর হাতে ভুলক্রমে একটি খুন সংঘটিত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে খোঁটা দেয়। মূসা (আঃ) অজ্ঞতার কারণে হত্যা করার কথা স্বীকার করেন এবং মনে করিয়ে দেন বনী ইসরাইলের উপর ফিরআউনের অত্যাচার এর চেয়ে বহুগুণে বেশি। ফিরআউন এবার মু’জিযা দেখতে চায়। তাকে লাঠি সাপে পরিণত হওয়া ও আলোকিত হাতের মু’জিযা দেখানো হয়। সে ভড়কে যায় যে মূসা (আঃ) জাদু করে তাদেরকে দেশ থেকে উৎখাত করবেন। সে সারা দেশের জাদুকরদের ডেকে নানা লোভ দেখিয়ে মূসার সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করে। জাদুকররা ফিরআউনের নামে লাঠি-দড়ি ইত্যাদি নিক্ষেপ করে। মূসা (আঃ) তাঁর লাঠি নিক্ষেপ করলে তা সাপ হয়ে গিয়ে জাদুকরদের লাঠি-দড়িকে গিলে ফেলে। তাদের জাদু ও মূসার মু’জিযার পার্থক্য স্পষ্ট বুঝতে পেরে জাদুকররা ঈমান এনে সেজদায় পড়ে যায়। ফিরআউন রাগে দিশেহারা হয়ে বলে, মূসাই তোমাদের সর্দার। সে তোমাদের জাদু শিখিয়ে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করাচ্ছে। ইত্যাদি। সে জাদুকরদের শাস্তির ভয় দেখায়। জাদুকররা ঈমানদীপ্ত জবাব দেয়। মূসা (আঃ) বনী ইসরাইলকে নিয়ে যাত্রা করেন। ফিরআউন তার বাহিনী নিয়ে ধাওয়া করে। এভাবে আল্লাহ ফিরআউন বাহিনীকে তাদের কমফোর্ট জোন থেকে বের করে আনেন। লোহিত সাগরের পাড়ে এসে বনী ইসরাইল ভাবে যে তারা ধরা পড়ে যাবে। মূসা (আঃ) আল্লাহর ওপর তাওয়াককুল করতে বলেন। আল্লাহ লোহিত সাগরে পথ করে দিয়ে বনী ইসরাইলকে পার করে নেন আর ফিরআউনের লস্করকে ডুবিয়ে মারেন।
ইবরাহীম (আঃ) এর সাথে তাঁর কওমের মুশরিকদের বাদানুবাদ উল্লেখ করা হয়। মুশরিকরা দেবদেবীর উপাসনা করে, কারণ তারা তাদের বাপদাদাদের তা করতে দেখেছে। আর ইবরাহীম (আঃ) সৃষ্টিজগতের ওপর আল্লাহর সর্বব্যাপী ক্ষমতার উল্লেখ করে কল্পিত দেবদেবী ও পূজারীদের সাথে শত্রুতা ঘোষণা করেন।
কাফিরদেরকে তাদের মিথ্যা দেবদেবীসহ উপুড় করে জাহান্নামে নেওয়া হবে (যেসব নবী, ফেরেশতা ও বুজুর্গদের উপাসনা করা হয়, তাঁরা এর অন্তর্ভুক্ত নন)। সেখানে তারা নিজেদের নেতাদের দোষারোপ করতে থাকবে আর মুমিন না হওয়ার কারণে আফসোস করতে থাকবে।
নূহ (আঃ) তাঁর কওমকে দাওয়াত দিলে সেখানকার নেতারা খোঁটা দেয় যে নূহের সাথে কেবল সমাজের নিচু স্তরের মানুষেরাই যোগ দেয়। তাদের অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তাদেরকে নিমজ্জিত করেন এবং ঈমানদারদের রক্ষা করেন।
আদ জাতিকেও হুদ (আঃ) একইভাবে বিনা পারিশ্রমিকে তাওহীদের দাওয়াত দেন। আদ জাতি অযথা দাপট দেখাতে বিভিন্ন সৌধ ও ইমারত বানাত যেন সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর অন্যান্য জাতিকে জুলুম করত। হুদ (আঃ) স্মরণ করিয়ে দেন এসব ক্ষমতা প্রতিপত্তি পরীক্ষাস্বরূপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা ঈমান আনতে অস্বীকার করে ধ্বংস হয়।
সামুদ জাতিকে সালিহ (আঃ) একইভাবে দাওয়াত দেন। তারা তাদের প্রস্রবণ, বাগান, পাহাড় কেটে বানানো সুদৃঢ় আবাসে চিরকাল থাকবে- এরকম ধ্যান ধারণা নিয়ে চলত। সালিহ (আঃ)-কে তারা জাদুগ্রস্ত আখ্যায়িত করে। মু’জিযাস্বরূপ আনীত উটনীকে হত্যা করে ফেলে। সালিহ (আঃ)-কেও হত্যার পরিকল্পনা করে। ফলে তারা আযাবে নিপতিত হয়।
লূত (আঃ) একইভাবে তাঁর কওমকে দাওয়াত দেন ও সমকামিতা হতে বিরত থাকতে বলেন। তারা হঠকারিতা দেখায়। পাথরবৃষ্টির মাধ্যমে তাদের সকলকে ধ্বংস করা হয়। লূত (আঃ) এর স্ত্রী তাদের প্রতি সহানুভূতিশীলা হওয়ায় সেও আযাবে পতিত হয়।
আয়কা (মাদইয়ান) এর অধিবাসীদের শুআইব (আঃ) একইভাবে দাওয়াত দেন, মাপে কমবেশি করে লোক ঠকাতে ও দস্যুবৃত্তি করতে নিষেধ করেন। তারা তাঁকে জাদুগ্রস্ত বলে এবং নিজেদের মতোই একজন মানুষকে নবী মানতে অস্বীকার করে। প্রতিশ্রুত আযাব নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ করে। ফলে তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
কাফিররা দাবি করত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছে শয়তান এসব বাণী নিয়ে আসে। অথবা তিনি কোনো কবি। তাদেরকে খণ্ডন করে বলা হয় এখানে যেসকল উত্তম কথাবার্তা বলা আছে, এগুলো তো শয়তানের ঘোর অপছন্দের জিনিস। শয়তান বরং নাযিল হয় মিথ্যাবাদী পাপিষ্ঠদের ওপর। আসলে কাফিররা ঈমান না আনার প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে। কোনো অনারব এসেও যদি তাদের সামনে আরবি কুরআন শুনিয়ে দিত, তবু তারা ঈমান আনত না। বনী ইসরাইলের আলেমরা জানে যে তাদের কিতাবে এই কুরআনের ব্যাপারে বলা আছে। আর কবিরা তো কেবল কাল্পনিক কথাবার্তা বলে। যা বলে, নিজেরাই তা করে না। কুরআন তো এমন নয়। (তবে ইসলামের পক্ষে রচিত কবিতার কথা আলাদা। যেমন হাসসান বিন সাবিত (রাঃ) এরকম কবিতা লিখে কাফিরদের ইসলামবিদ্বেষী কবিতার জবাব দিতেন।)
২৭। সূরা নামল, আয়াত ১ থেকে ৫৯
সূরা নামলের শুরুতে দুইটি এমন জাতির পার্থক্য দেখানো হয়েছে যারা সম্পদ-রাজত্ব-প্রতিপত্তি নিয়ে দুই রকমের আচরণ করেছে। প্রথমে মূসা (আঃ) কর্তৃক ফিআউনের কাছে দাওয়াহ প্রদান ও তার প্রতি ফিরআউনের কুফরির ঘটনা বলা হয়। শয়তানের প্ররোচনায় দুনিয়াবি চাকচিক্যকে তারা উত্তম মনে করেছিল। ফলে আল্লাহর আয়াতের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে।
অপরদিকে সুলায়মান (আঃ) ছিলেন সাচ্চা তাওহীদবাদী। তাঁকে জ্বীন, মানুষ ও পাখির এক বিশাল সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়। পশুপাখির কথা বোঝার ক্ষমতা দেওয়া হয়। এক পিঁপড়ার উপত্যকার কাছে দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি শুনতে পান একটি পিঁপড়া তার জাতিকে বলছে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে, নাহলে সুলাইমানের বাহিনী তাদের পিষ্ট করে ফেলতে পারে। সুলাইমান (আঃ) স্মিত হেসে ফেলেন, আল্লাহর কাছে দু’আ করেন শোকরগুজার ও নেককার বান্দা হওয়ার জন্য।
তাঁর কাছে হুদহুদ পাখি সাবা রাজ্যের খবর নিয়ে আসে। সেখানকার শাসক ছিলেন এক রাণী (বিলকিস) আর সে জাতি ছিলো সূর্যপূজারী। সুলাইমান (আঃ) বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করা একটি চিঠি পাঠিয়ে তাদের তাওহীদ গ্রহণ করার আদেশ দেন এবং আত্মসমর্পণ করে তাঁর দরবারে আসতে বলেন। বিলকিস তাঁর সভাসদদের সাথে পরামর্শ করেন। তারা বলে যে তারা লড়াকু জাতি, রাণী যদি সুলাইমানের সাথে যুদ্ধের আদেশ দেন, তাহলে তারা প্রস্তুত আছে। রাণী বরং যুদ্ধের ভয়াবহতা বিবেচনা করে সুলাইমানের নিকট উপঢৌকন সহ দূত পাঠান। সুলাইমান (আঃ) বলে দেন যে আল্লাহ তাঁকে যা দিয়েছেন, তা এরচেয়ে উত্তম।
বিলকিস সুলাইমানের দরবারে আসার জন্য রওনা দেন। বিলকিসের সিংহাসনটি সুলাইমান (আঃ) নিজ দরবারে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন। একজন শক্তিশালী জ্বীন এ কাজে রাজি হয়। তবে তার আগেই আসমানী কিতাবের জ্ঞানধারী এক ব্যক্তি আল্লাহপ্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতায় এ কাজটি সম্পাদন করে দেন। সুলাইমান (আঃ) সিংহাসনটির আকৃতি কিছুটা পরিবর্তন করে দেন। বিলকিস এসে চিনতে পারেন যে তাঁর সিংহাসন তিনি আসার আগেই এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। এছাড়া তিনি সুলাইমানের প্রাসাদের স্বচ্ছ কাঁচনির্মিত মেঝে দেখেন, যা দেখলে জলাশয় মনে হয়। তাওহীদের প্রতি আগেই তাঁর মন ঝুঁকি গিয়েছিল। সুলাইমানের সম্পদ-প্রতিপত্তি দেখে আরো ঈমান বৃদ্ধি পায়। এভাবে সুলাইমান ও বিলকিস প্রচুর ক্ষমতার মালিক হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর দ্বীনের সাথে কোনো অহংকার প্রদর্শন করেননি।
সালিহ (আঃ) এর ঘটনা পূর্বের মতোই বর্ণিত হয়। নয়জন লোক যে উটনী হত্যায় ভূমিকা পালন করে, তা বলা হয়। লূত (আঃ) এর ঘটনা পূর্বের মতো বলা হয়। তাঁর কওম তাঁর দাওয়াহ শুনে বলেছিলো এদেরকে এখান থেকে বের করে দাও, এরা তো বেশি পাকপবিত্র থাকতে চায়!