২৭। সূরা নামল, আয়াত ৬০ থেকে ৯৩

আল্লাহর বিভিন্ন নিয়ামাতের কথা স্মরণ করিয়ে বারবার জিজ্ঞেস করা হয়েছে কী করে অন্য কোনো ইলাহ থাকতে পারে। বৃষ্টিবর্ষণ, উদ্ভিদ জন্মানো, বসবাসের পৃথিবী, পাহাড়, পৃথক পৃথক জলাধার সৃষ্টি, দোয়া কবুল করা, বৃষ্টিবাহী বায়ু প্রেরণ, রিযিক সরবরাহ। আল্লাহ ছাড়া কেউ গায়েবের জ্ঞান রাখে না, তিনিই আখিরাতে পুনঃসৃষ্টি করতে সক্ষম।

কাফিররা আখিরাতের পুনরুত্থান অবাস্তব মনে করে। বলে যে এসব কিসসা কাহিনী তাদের বাপদাদাদেরকেও শোনানো হতো। এসকল কাফিরদেরকে বলা হয় জমিনে ভ্রমণ করে অপরাধী জাতিগুলোর পরিণাম দেখে নিতে। তারা প্রতিশ্রুত আযাব নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ করে, অথচ হয়তো সত্যিই আযাবের সময় নিকটে চলে এসেছে। আল্লাহ দয়ালু বলেই এখনো সুযোগ দিয়ে রেখেছেন। গুপ্ত ও প্রকাশ্য সকল বিষয় আল্লাহর জানা। রাসূলের (সাঃ) আগমন আহলে কিতাবদের নিকট একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ। তবু যারা আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করে, তাদেরকে বধির, মৃত ও অন্ধের সাথে তুলনা করা হয়। কিয়ামাত নিকটে চলে আসলে আলামত হিসেবে জমিন থেকে কোনো একটি প্রাণী বের করা হবে যা তাদের সাথে কথা বলবে। (কিছু রেওয়ায়ত থেকে জানা যায় এ ঘটনার পর ঈমান আনলে আর তা গৃহীত হবে না।)

কিয়ামাতের দিন প্রত্যেক উম্মত থেকে কাফিরদের দলগুলোকে এনে সমবেত করা হবে। সেদিন এরা ঘাবড়ানো অবস্থায় থাকবে। ঈমানদার নেকআমলকারীরা ভয়ভীতি থেকে মুক্ত থাকবে। আজ যে পাহাড়গুলো নিশ্চল দেখা যাচ্ছে, শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার পর তারা মেঘের মতো সঞ্চালিত হবে। যে ব্যক্তি হিদায়াতের পথে আসলো, সে নিজের কল্যাণার্থেই আসলো।

২৮। সূরা ক্বাসাস

সূরা ক্বাসাস শুরু হয়েছে মূসা (আঃ) এর শুরুর দিকের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে। ফিরআউন বনী ইসরাইলের পুত্র সন্তানদের মেরে ফেলতো। মূসার জন্মের পর তাঁর মা পেরেশান হয়ে যান। আল্লাহ তাঁকে ইলহাম করেন তিনি যেন শিশুটিকে দুধ পান করাতে থাকেন, আর আল্লাহর নির্দেশ আসলে নদীতে ফেলে দেন। কথামতো কাজ করার পর ফিরআউনের লস্কর শিশু মূসাকে তুলে নেয়। তারা বুঝতে পারেনি এ শিশু তাদের শত্রু ও দুঃখের কারণ হবে। ফিরআউন তার স্ত্রী আসিয়া (আঃ) এর অনুরোধে শিশু মূসাকে রেখে দেয়। মূসা (আঃ) বড় হলে আল্লাহ তাঁকে হিকমত ও জ্ঞান দান করেন।

এক কিবতী আর এক ইসরাইলীকে ঝগড়া করতে দেখে মূসা (আঃ) কিবতীকে আঘাত করেন, এতেই সে মরে যায়। মূসা (আঃ) আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান, আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করেন। মূসা (আঃ) বলেন, আল্লাহ যেহেতু একবার তাঁকে মাফ করেছেন, তিনি আর কখনো জালিমদের সহযোগী হবেন না।

পরদিন ওই ইসরাইলীকে আরেক কিবতীর সাথে ঝগড়া করতে দেখা যায়। সে মূসাকে (আঃ) সাহায্যের জন্য ডাকে। ওই ইসরাইলীই যে আসল ঝামেলা পাকানো লোক, তা মূসা (আঃ) বুঝতে পারেন ও তাকে তা বলেন। তারপরও কিবতীর বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করতে হাত বাড়ান। ইসরাইলী ভাবে তাকেই মারতে আসছে। সে মূসাকে (আঃ) অকৃতজ্ঞের মতো তিরস্কার করে। শহরের দূর প্রান্ত থেকে এক লোক এসে খবর দেয় যে গতকালের হত্যার বদলা নিতে নেতারা মূসাকে (আঃ) খুঁজছে।

মূসা (আঃ) পালিয়ে মাদায়েনে আসেন। সেখানে একদল রাখাল তাদের পশুদের পানি পান করাতে কুয়ো থেকে পানি নিতে ভিড় করে ছিল। দুজন নারী তাদের পশুগুলো নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মূসা (আঃ) জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন তাঁদের পিতা অতিবৃদ্ধ বলে পশু চরাতে পারেন না। আর ঠেলাঠেলির কারণে নারীদ্বয়কে সবার পরে পানি নেওয়া লাগে। মূসা (আঃ) তাঁদেরকে পানি সংগ্রহ করে দেন।

তারপর তিনি এক জায়গায় বসে দু’আ করেন, আল্লাহ তাঁকে যে অনুগ্রহই করবেন, তিনি তার মুখাপেক্ষী। নারীদ্বয়ের একজন যথাযথ লজ্জাশীলতা বজায় রেখে এসে বলেন তাঁর পিতা দেখা করতে চান। দেখা করার পর ওই বৃদ্ধ ব্যক্তি মূসা (আঃ) এর সাথে এক মেয়ের বিয়ে দিতে চান এবং নির্দিষ্ট মেয়াদে তাঁর জন্য কাজ করতে বলেন। মূসা (আঃ) রাজি হন।

মেয়াদ শেষে স্ত্রী সহ মিশরে ফেরার পথে তূর পাহাড়ে নবুওয়ত ও মু’জিযা প্রাপ্তি, মিশরে গিয়ে ফিরআউনকে দাওয়াত দেওয়া পর্যন্ত ঘটনা বর্ণিত হয়। ফিরআউন ঠাট্টা করে তার পরিষদ হামানকে বলে, আমার জন্য উঁচু ইমারত বানাও তো, আসমানে উঁকি মেরে মূসার রবকে দেখে আসি! পরের ঘটনাচক্রে ফিরআউন ও তার লস্কর সাগরে নিমজ্জিত হয়। আর আখিরাতের শাস্তি তো কঠিনতর।

এসব ঘটনা রাসূল (সাঃ) জানতেন না, আল্লাহ ওয়াহী করে জানিয়েছেন। মক্কার মুশরিকরা মু’জিযা দেখতে চাইত। অথচ ফিরআউন এত বড় দুটি মু’জিযা দেখেও ঈমান আনেনি। মুশরিকদের বলা হয় তাওরাত ও কুরআনের চেয়ে বেশি হিদায়াত সম্পন্ন কোনো কিতাব রচনা করে আনতে, কিন্তু তারা যে তা করতে অপারগ, তা তো জানা কথা।

আল্লাহ একের পর এক হিদায়াত পাঠান। এক কিতাবে ঈমান রাখা অবস্থায় যারা পরবর্তী নবীর প্রতি ঈমান আনে, তাদের জন্য দ্বিগুণ পুরষ্কার। অনেকে বলত ঈমান আনলে জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। অথচ কাফিররা যে বিত্ত বৈভবে আছে, তা অল্প কয়েকদিনের নিরাপত্তা মাত্র। বরং আল্লাহ বিরান মক্কাভূমিতেও সমস্ত জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করাচ্ছেন। আগে কত জাতি কুফরি করে ধ্বংস হয়ে গেছে! আখিরাতের প্রতিদানই স্থায়ী।

কিয়ামাতের দিন আল্লাহ সেসব সত্ত্বাকে উপস্থিত করতে বলবেন, যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করা হতো। তারা তাদের উপাসকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নতার ঘোষণা দেবে।

কাফিররা বলত তাদের মাঝ থেকে কোনো বিত্তবানকে নবী বানানো হলো না কেন। জবাবে বলা হয়, আল্লাহ যাকে চান তাকেই নবুওয়ত দিবেন, অন্য কারো ইখতিয়ার নেই।

আল্লাহ আমাদের কল্যাণার্থে রাত আর দিনের বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন। তিনি যদি কোনো একটিকে কিয়ামাত পর্যন্ত স্থায়ী করে দেন, কোনো মিথ্যা উপাস্য তা পরিবর্তন করতে পারবে না।

কারুনের ঘটনা বর্ণিত হয়। সে বনী ইসরাইলের একজন। তার সম্পদের চাবিগুলো বহন করতেও একদল শক্তিশালী লোক লাগত। অথচ সে নিজ সম্প্রদায়ের ওপরই জুলুম করত। তাকে নসিহত করা হলো অহংকার না করতে, আল্লাহর দেওয়া নিয়ামাতের শোকরগুজার হতে, এ সম্পদ দিয়ে দুনিয়া ও আখিরাত কামাই করতে। সে বলত, এসব সম্পদ সে নিজ জ্ঞানবলে অর্জন করেছে। দুনিয়ালোভীরা আশা করত, ইশ আমরাও যদি কারুনের মতো ধনী হতাম! ঈমানদাররা তাদের ধিক্কার দিত ও আখিরাতের প্রতিদানের কথা বলত। কারুন ও তার প্রাসাদকে আল্লাহ ভূগর্ভে ধসিয়ে দেন। কালকেই যারা তার মতো হতে চাইছিল, তারাই কারুনের মতো হতে না পারায় খুশি হয়ে গেল।

এ সূরা নাযিলের সময় মুসলিমরা হিজরত করা শুরু করেছিলেন। তাঁদেরকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে তাঁদেরকে এ ভূমিতে আবার ফিরিয়ে আনা হবে। তা যদি অকল্পনীয় হয়ে থাকে, এর আগে রাসূল (সাঃ) এর নবুওয়ত প্রাপ্তিও তো এক অপ্রত্যাশিত নিয়ামাত ছিল। কাজেই চিন্তার কিছু নেই।

২৯। সূরা আনকাবুত, আয়াত ১ থেকে ৪৪

মক্কার মুশরিকদের উৎপীড়নে অতিষ্ঠ মুমিনদেরকে সূরা আনকাবুতের শুরুতে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে, ঈমান এনেছি বললেই পার পাওয়া যাবে না। পূর্ববর্তী উম্মতদেরকেও আল্লাহ বিপদআপদের মধ্য দিয়ে পার করিয়ে প্রকৃত ঈমানদারদের বের করে এনেছেন।

মুশরিক পিতামাতারা তাদের মুসলিম সন্তানদেরকে দ্বীন ত্যাগ করার জন্য চাপ দিত। এ প্রসঙ্গে বলা হয় পিতামাতার আনুগত্য ও সদাচরণ করতে হবে ঠিক, কিন্তু তারা শির্কের দিকে ডাকলে সে কথা মানা যাবে না।

সুসময়ে দ্বীন মানা আর দুঃসময়ে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার স্বভাবকে তিরস্কার করা হয়েছে।

কাফিররা মুসলিমদের বলত দ্বীন ত্যাগ করলে কোনো বিপদ যদি আসেই, তাহলে তারাও তাদের সাথে তা ভাগ করে নেবে। আল্লাহ জানিয়ে দেন, বরং কাফিররাই নিজেদের প্রাপ্য আযাব ভোগ করবে, সেই সাথে যাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে তাদের আযাবের অংশও ভোগ করবে।

নূহ (আঃ), ইবরাহীম (আঃ), লূত (আঃ), হুদ (আঃ), সালিহ (আঃ), শুআইব (আঃ) ও মূসা (আঃ) কর্তৃক দ্বীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে দুঃখকষ্ট ভোগ করার ঘটনা সংক্ষেপে বলা হয়। তারপর তাঁদের শত্রুদের ওপর এমন আযাব এসেছে যে, পার্থিব জীবনের অল্প সময়ের ভোগবিলাস তাদের কোনো উপকারে আসেনি। এর মাঝেই ইবরাহীম (আঃ) ও লূত (আঃ) এর হিজরত এবং হিজরতের পর আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ লাভের ঘটনা বলে মুমিনদের হিজরতে উৎসাহিত করা হয়। আল্লাহকে ছেড়ে যারা অন্য অভিভাবক গ্রহণ করেছে, তারা যেন মাকড়সার (আনকাবুত) ঘরের মতো দুর্বল ঘর বানিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে।