২৩। সূরা মুমিনুন

জান্নাত লাভকারী সফল মুমিনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে- বিনীতভাবে সালাত আদায়কারী, অনর্থক বিষয়ে নির্লিপ্ত, যাকাতদাতা, লজ্জাস্থান হেফাজতকারী, আমানতদার, প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী, সালাতের রক্ষণাবেক্ষণকারী।

প্রথমে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি, তারপর মাতৃগর্ভে মানুষের পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন আল্লাহর কুদরত। তিনি আখিরাতেও এসব পুনঃসৃষ্টি করতে সক্ষম।

বৃষ্টির পানি জমিনে সংরক্ষণ, উদ্ভিদ ও গবাদি পশু থেকে প্রাপ্ত উপকার এবং নৌযানের নিয়ামাত স্মরণ করানো হয়েছে।

পরপর কয়েকজন নবীর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে- নূহ, নাম অনুল্লেখিত একজন, মূসা, হারুন, ঈসা (আলাইহিমুসসালাম)। তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে তাঁদের কওমকে দাওয়াত দিলে কওমের নেতারা তাঁদেরকে পাগল আখ্যায়িত করত। ফেরেশতার বদলে একজন মানুষ কেন নবী হলেন তা নিয়ে ঠাট্টা করত। আখিরাতের ধারণাকে অবাস্তব আখ্যায়িত করত, অহংকার করত। কোনো কওমের নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহ এদের এমন আযাব দিয়ে ধ্বংস করেন যে, এরা কেবল গল্প-ইতিহাস হয়ে যায়। সে জায়গায় নতুন কওমের বিস্তার করা হয় এবং তাদের পরীক্ষা শুরু হয়।

নবীগণ একই দ্বীন প্রচার করেছেন। কাফিররা নানা মতাদর্শ উদ্ভাবন করে নিজ নিজ মতাদর্শ নিয়ে খুশিতে আছে। কাফিররা নিজেদের অর্থবিত্তের প্রাচুর্যের দিকে ইঙ্গিত করে বলে তারাই সঠিক পথে আছে। আল্লাহ জানিয়ে দেন যে দুনিয়াবি প্রাচুর্য হক-বাতিলের মানদণ্ড নয়। এসব ঐশ্বর্যশালী লোকদের যখন আযাবে পাকড়াও করা হবে, তারা দিশাহারা হয়ে যাবে। তাদেরকে সংকট ও প্রাচুর্য উভয় অবস্থা দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে, কখনোই তারা আল্লাহর দিকে ফেরে না।

রাসূলকে (সাঃ) দীর্ঘদিন চেনার পরও তাঁর ওপর পাগল, লোভী ইত্যাদি অপবাদ আরোপ করে কাফিররা যে স্ববিরোধিতামূলক কথা বলত, তা খণ্ডন করা হয়েছে।

মুশরিকরা সৃষ্টিকর্মে আল্লাহকেই একক মানতো। কিন্তু আল্লাহরই হুকুম তাওহীদ ও আখিরাতের বিশ্বাসকে তারা অস্বীকার করে। বলে যে এসব হুমকি তাদের বাপদাদাদের কাছেও এসেছে, এসব আদিকালের উপকথা মাত্র। একাধিক ইলাহ থাকলে যে তারা পরস্পর বিবাদ করে সৃষ্টিজগত বিশৃঙ্খল করে ফেলত, তা উল্লেখ করে তাদের শিরকি আকিদার অসারতা দেখানো হয়েছে। মন্দকে উত্তম দিয়ে প্রতিহত করতে বলা হয়েছে।

আল্লাহ চাইলে সাথে সাথেই আযাব দিয়ে কাফিরদের ধ্বংস করতে পারেন। কিন্তু তিনি তা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত বিলম্বিত করে পরীক্ষা নেন। কিয়ামাত দিবসে এমন বিপদ হবে যে কেউ কারো আত্মীয়তার খবর রাখবে না। কাফিররা দুনিয়ায় আল্লাহর বিধান ও মুমিনদের উপহাস করত। জাহান্নামে ঝলসানোর সময় তারা দু’আ করবে তাদের যেন দুনিয়ায় আবার ফেরত পাঠানো হয়, এবার তারা নেক আমল করবে। এটা আসলে মুখের কথা। তাদের পুনরায় পাঠালেও তারা বদ আমলই করত। শাস্তির দীর্ঘতা উপলব্ধি করে তাদের কাছে মনে হবে দুনিয়ার সুখশান্তিতে তারা একদিন বা তারও কম সময় ছিল। কতই না ভালো হতো যদি তারা তা আগেই উপলব্ধি করত।

মুমিনদেরকে হুকুম করা হয় আল্লাহর মাগফিরাত ও রহমত কামনা করে দু’আ করতে।

২৪। সূরা নূর

সূরা নূরের শুরুতে ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর শাস্তি, তাদের বিবাহের বিধান, সতী নারীর ওপর ব্যভিচারের অপবাদ আরোপকারীর শাস্তির বিধান, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে লিআন-এর বিধান আলোচিত হয়।

বনু মুস্তালিকের যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে এক ঘটনায় মুনাফিকরা আয়িশা (রাঃ) এর উপর ব্যভিচারের অপবাদ দেয়। এটি 'ইফক' এর ঘটনা নামে খ্যাত। এ ঘটনার আলোকে মিথ্যা অপবাদের ভয়াবহতা, মুখে মুখে গুজব ছড়ানোর ভয়াবহতা, প্রমাণবিহীন অপবাদ কানে আসলে মুমিনদের করণীয়, মুমিনদের মাঝে অশ্লীলতার প্রসার কামনার ভয়াবহতা বর্ণিত হয়েছে।

মুনাফিকদের অপপ্রচারে যেসকল সরলমনা মুসলিম বিভ্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁদের একজনকে আবু বকর (রাঃ) আর্থিক সাহায্য করতেন। এ ঘটনার পর তিনি তাঁকে আর সাহায্য না করার ব্যাপারে কসম করে ফেলেন। ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে অপর মুমিনকে সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার এ আচরণ আল্লাহ নিষেধ করেন। ফলে আবু বকর (রাঃ) আর্থিক সাহায্য প্রদান জারি রাখেন।

দুশ্চরিত্র নারী-পুরুষ পরস্পরের উপযুক্ত আর সচ্চরিত্র নারী-পুরুষ পরস্পরের উপযুক্ত।

অন্যের ঘরে ঢুকতে অনুমতি নেওয়ার বিধান বর্ণনা করা হয়। নারী-পুরুষের পর্দার বিধান, কাদের সামনে পর্দা করতে হবে না তার বিধান আলোচিত হয়। বিবাহের গুরুত্ব, অভাবগ্রস্ত অবস্থায় বিবাহের বিধান বর্ণিত হয়। জাহিলি যুগে মনিবরা দাসীদের দিয়ে বেশ্যাবৃত্তি করিয়ে টাকা রোজগার করত, এটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

আল্লাহর নূরের ব্যাপারে একটি চমৎকার উপমা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ যাকে চান, তাঁর নূরের দিকে পথ দেখান। এসব লোকের চাকরি-ব্যবসা তাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করতে পারে না। আল্লাহ তাদের যথাযথ প্রতিদান দেবেন। আর কাফিরদের কাজগুলো হলো মরিচীকার মতো, অথবা সাগরতলের কয়েক স্তরের আঁধারের মতো, যার কোনো ভালো প্রতিদান নেই।

সমগ্র সৃষ্টিজগত আল্লাহর শেখানো তরিকায় নিজ নিজ জায়গায় আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করে।

মুনাফিকরা মুখে ঈমানের দাবি করে। যখন নিজের সুবিধা দেখে, তখন কুরআন-সুন্নাহর বিচার মানে। আর তাদের স্বার্থের বিপরীতে গেলে কুরআন-সুন্নাহর ফায়সালা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। মুমিনরা তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম শুনলেই মেনে নেয়।

যখন জিহাদ থাকত না, তখন মুনাফিকরা কসম করে বলত জিহাদের ঘোষণা আসলে তারা বের হবে। অথচ আসল সময়ে নানা অজুহাত দেয়।

ঈমানদার ও নেক আমলকারীরা জুলুম-অত্যাচারের যুগ কাটিয়ে একদিন নিরাপত্তার সহিত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে- এ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

ঘরে প্রবেশের সময় অনুমতি নেওয়ার আরো কিছু বিধান, একত্রে ও আলাদা খাওয়ার বিধান ও সালামের ফজিলত বর্ণিত হয়।

খন্দক যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় রাসূল (সাঃ) সবাইকে কাজ ভাগ করে দেন। মুমিনগণের কোনো দরকার পড়লে রাসূলের (সাঃ) অনুমতি নিয়ে যেতেন। আর মুনাফিকরা এমনি এমনিই ফাঁকি দিয়ে সটকে পড়ত। এ ঘটনার আলোকে রাসূলের (সাঃ) নির্দেশ মানার গুরুত্ব, অনুমতি নেওয়া ও দেওয়ার বিধান আলোচিত হয়।

২৫। সূরা ফুরক্বান, আয়াত ১ থেকে ২০

সূরা ফুরক্বানের শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা করে বলা হয় যে তিনি রাসূলের (সাঃ) এর ওপর ফুরক্বান [(সত্য-মিথ্যার মাঝে) পার্থক্যকারী মানদণ্ড] নাযিল করেছেন।

আল্লাহকে ছেড়ে এমন উপাস্য গ্রহণ করাকে তিরস্কার করা হয়, যারা নিজেরই কোনো উপকার-অপকারের ক্ষমতা রাখে না।

কাফিররা এত রকমের অভিযোগ তুলত যে তারা নিজেরাই জানে না কোনটা সঠিক। একবার বলে কোনো ইহুদী রাসূলকে (সাঃ) এসব শেখায়, একবার বলে তিনি যাদুগ্রস্ত, একবার বলে এ কেমন রাসূল যে খাবার খায়-হাটবাজারে যায়, তাঁকে আল্লাহর ধনভাণ্ডার দেওয়া হলো না কেন ইত্যাদি। অথচ আগের নবীগণও মানুষ ছিলেন।

আল্লাহ চাইলেই যাকে-তাকে অকল্পনীয় ধনভাণ্ডার দিতে পারেন। কিন্তু আসল প্রতিদান তো আখিরাতে। সেখানে কাফিররা জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করতে করতে মৃত্যুকে ডাকবে। কিন্তু তারা মরবেও না, শাস্তিও কমবে না। বিপরীতে মুত্তাকীরা পাবে স্থায়ী জান্নাত। কাফিররা যেসব মিথ্যা উপাস্যের উপাসনা করত, তারা নিজেরাই আখিরাতে তাদের উপাসকদের সাথে বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করবে।