০৩। সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৯২-২০০

আল্লাহর রাস্তায় নিজের প্রিয়বস্তু খরচ করতে বলা হয়। তারপর আহলে কিতাবদের কয়েকটি আপত্তির জবাব দেওয়া হয়। পূর্বের নবীদের শরিয়তের কিছু হারাম জিনিস কেন মুহাম্মাদ (সাঃ) এর শরিয়তে হালাল করা হলো, তার হেকমত বর্ণিত হয়। এছাড়া আহলে কিতাবরা বলত মুসলিমরা কেন পূর্ববর্তী নবীদের কিবলা মাসজিদুল আকসার দিকে ফিরে নামাজ পড়ে না। জবাবে বলা হয় ইবরাহীম (আঃ) এর হাতে তৈরি মাসজিদুল হারাম তো আকসার আগে থেকেই ছিল আর প্রথম থেকেই এটা পবিত্র স্থান। ইবরাহীম (আঃ) কে সম্মান করা আহলে কিতাবরা ঠিকই এসব বিষয় জানে, জেনেশুনে শুধু শুধুই জিদের বশে এসব আপত্তি তোলে।

মদীনার স্থানীয় দুই গোত্র আওস-খাযরাজ ছিলো পরস্পরের জানের দুশমন। ইসলাম গ্রহণের পর আল্লাহ তাদের মাঝে এমন সম্প্রীতি তৈরি করে দেন যে তারা ভালো কাজে প্রতিযোগিতা শুরু করে। ইহুদীরা তা দেখে অন্তর্জ্বালায় ভুগত। একবার তাদের একজন জাহিলি যুগের কথাগুলো বর্ণনা করে আগের সেই হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আল্লাহ আয়াত নাযিল করে আওস-খাযরাজকে দ্বীনি ভ্রার্তৃত্ব অটুট রাখার জন্য মর্মস্পর্শী নসিহত করেন। ইহুদীদের সম্পর্কে বলা হয় জাতিগতভাবেই তারা লাঞ্ছনার সিল মারা জাতি। বাইরের শক্তির সাহায্য ছাড়া তারা কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। তবে আহলে কিতাবদের সকলে একরকম নয়। যারা তাদের মাঝ থেকে ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, তাদের প্রশংসা করা হয়।

কাফিরদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়। তারা অন্তরে কী পরিমাণ বিদ্বেষ পোষণ করে, তা উন্মোচন করা হয়।

তারপর উহুদ যুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে সুদীর্ঘ নসিহত করা হয়। উহুদের সংক্ষিপ্ত ঘটনা হলো মুশরিকদের আক্রমণ প্রতিহত করতে রাসূল (সাঃ) এক হাজার সৈন্যের ছোট দল নিয়ে অগ্রসর হন। মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ৩০০ জনকে নিয়ে মাঝপথ থেকে ফিরে আসে। যুদ্ধের ময়দানে রাসূল (সাঃ) এক জায়গায় ৫০ জন তীরন্দাজ নিযুক্ত করে সেখানেই স্থির থাকার কঠোর নির্দেশ দেন। প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিমরা আপাত জয়লাভ করে। কাফিরদের পালাতে দেখে তীরন্দাজদের বেশিরভাগই গনীমত সংগ্রহ করতে চলে আসেন। কাফিররা উল্টো দিক দিয়ে ঘুরে আবার আক্রমণ করলে মুসলিমরা বিপদে পড়ে যান। রাসূল (সাঃ) এর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তারপরও আল্লাহর ইচ্ছায় মুসলিমরা আবার গুছিয়ে নিয়ে পাল্টা প্রতিরোধ করে। কাফিররা কেন যেন যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি করা হয়েছে ভেবে ফিরে চলে যেতে থাকে। আল্লাহরই ইচ্ছা! তারপর আফসোস করে মাঝপথে ভাবে মুসলিমদের একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়ে আসা যেত। এই ভেবে আবার তারা আক্রমণে উদ্যত হয়। ওদিকে রাসূল (সাঃ) এর পুনর্নির্দেশে ক্লান্ত সাহাবাগণ শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবনে বীরবিক্রমে এগিয়ে আসেন। খবর পেয়ে মুশরিকরা অবশেষে সোজা বাড়ির পথ ধরে। বাহ্যিকভাবে মুসলিমরা উহুদে পরাজিত হয়। কিন্তু অনেক মুফাসসির একে বিজয় বলেছেন, কারণ উহুদ ছিলো শিক্ষার এক খনি।

মুনাফিকদের মতো সংখ্যাধিক্যকে ভয় না পেয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে। বদর যুদ্ধে কীভাবে আল্লাহ সাহায্য করেছেন তা স্মরণ করানো হয়।

মুশরিকরা যুদ্ধে শক্তি বাড়াতে সুদে ঋণ নিয়েছিল। মুসলিমদের আল্লাহ এসব হারাম পথে পা বাড়াতে নিষেধ করেন। সৎকাজে প্রতিযোগিতা করা, সচ্ছল-অসচ্ছল উভয় অবস্থায় দানসদকা, রাগ গিলে ফেলা, ক্ষমা করা, গুনাহ হয়ে গেলে দ্রুত তাওবাহ করার অভ্যাস যাদের আছে, তাদের জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

মুমিনরাই সবশেষে বিজয়ী হবে। ইতিহাসে সীমালঙ্ঘনকারী বিভিন্ন জাতির কী অবস্থা হয়েছে, তা জমিনে ঘোরাফেরা করে দেখতে বলা হয়। আর যুদ্ধে আল্লাহ জয়ও দিবেন, পরাজয়ও দিবেন। এটাই আল্লাহর পরীক্ষা, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। শহীদের মর্যাদা এমনি এমনি পাওয়া যায় না। কষ্ট করতে হয়।

মুহাম্মাদ (সাঃ) একজন রাসূল মাত্র, তাঁর আগেও অনেক নবী-রাসূল গত হয়েছেন। তিনি মারা গেলে কি আমরা ইবাদাত করা ছেড়ে দেব? না, বরং মৃত্যু পর্যন্ত দ্বীনের ওপর অটল থাকতে হবে। আগের যুগেও আল্লাহওয়ালা লোকেরা নবীদের সাথে মিলে দৃঢ়পদে যুদ্ধ করেছেন। আল্লাহ তাদের উভয় জাহানে কামিয়াবি দিয়েছেন।

গনীমতের মাল পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে যাবার কিছু নেই। শেষপর্যন্ত তা তো শরিয়ত অনুযায়ী বণ্টিত হবে। কেউ কমবেশি করলে গুনাহগার হবে। যাইহোক, এ যুদ্ধে মুসলিমদের এসব ভুলত্রুটি আল্লাহ মাফ করে দিয়েছেন। রাসূল (সাঃ) তাঁর কোমল স্বভাবের কারণে কিছু বলেননি।

মুনাফিকরা ভাবে যে তারা জিহাদে না গিয়ে বেঁচে গেছে। শহীদদের সম্পর্কে তারা বলে, “এরা আমাদের সাথে বসে থাকলে আজকে মারা যেত না।” আল্লাহ বলেন, মৃত্যু যদি এদের তাকদিরে থাকতই, তারা ঘর থেকে বের হয়ে নিজ গরজে মৃত্যুর জায়গায় চলে যেত। আর শহীদদেরকে মৃত ভাবা যাবে না। তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে জান্নাতি রিযিক পান। আর সাথী ভাইয়েরাও শহীদ হয়ে তাঁদের সাথে যোগ দেবে, এই আশায় উন্মুখ হয়ে আছেন। জিহাদে গেলেই বরং আল্লাহ সম্মান সহকারে বিজয় দেন। সেখান থেকে জীবিত না ফিরলেও আল্লাহর ক্ষমা তো পাওয়া হয়েই যায়। মুনাফিকরা পারলে নিজেরা চির অমর হয়ে দেখাক!

মুমিনদেরকে যদি বলা হয় তোমাদের বিরুদ্ধে বিশাল বাহিনী জমা হয়েছে, এতে তাদের ঈমান আরো বেড়ে যায়। আল্লাহ বিভিন্ন পরীক্ষায় ফেলে মুনাফিকদেরকে মুমিনদের মাঝ থেকে ছেঁকে বের করে নেন।

আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করতে কৃপণতা করলে আখিরাতে সাজা ভোগ করতে হবে। আহলে কিতাবরা দান সদকার কথা শুনে ঠাট্টা করে বলত, “আল্লাহ গরীব, আমরা ধনী।” তাদের এই গুনাহের কথার ব্যাপারে আখিরাতের শাস্তির কথা বলা হয়। সম্পদ কুক্ষিগত করে স্বচ্ছন্দে থাকা লোকদের দেখে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না। আখিরাতে তাদের পরিণতি মন্দ।

পূর্বের যুগে কুরবানির গোশত খাওয়া হালাল ছিল না। কুরবানি কবুল হলে আসমান থেকে আগুন এসে তা জ্বালিয়ে দিত। আহলে কিতাবরা মুসলিমদেরকে এরকম একটা নিদর্শন দেখানোর চ্যালেঞ্জ করে। আল্লাহ তাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে আগেও তাদের সামনে এমন সুস্পষ্ট নিদর্শন ও কিতাব নিয়ে অনেক নবীই এসেছিলেন। তারা তো ঈমান আনেইনি, বরং তাঁদের হত্যা করেছে ও কিতাব বিকৃত করেছে। তবে তাদের মাঝে যারা ঈমান এনেছে ও আল্লাহর কিতাবকে দুনিয়াবি স্বার্থে স্বল্পমূল্যে বেচে দেয়নি, তাদের প্রশংসা করা হয়। আহলে কিতাব ও মুশরিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ভবিষ্যতে আরো অনেক তীর্যক কথাবার্তার সম্মুখীন হতে হবে এই মর্মে মুসলিমদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়।

আল্লাহ এই সৃষ্টিজগত অনর্থক সৃষ্টি করেননি। এই সৃষ্টিজগত নিয়ে চিন্তাফিকিরকারী লোকেরা আল্লাহর অস্তিত্ব অনুধাবন করে তাঁর কাছে সর্বক্ষণ ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ তাদের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের দু’আ কবুল করার প্রতিশ্রুতি দেন।

০৪। সূরা নিসা, আয়াত ১-৮৬

সূরা নিসার শুরুতে আল্লাহকে ভয় করা, আত্মীয়ের হক আদায় করা, ইয়াতীমদের লালনপালন, বিবাহ, ইয়াতীমদের বিবাহ দেওয়া বা করা, দাসদাসীদের বিবাহ দেওয়া বা করা, সম্পদের উত্তরাধিকারে নারীপুরুষের অংশ ইত্যাদি সম্পর্কিত বিশদ আলোচনা করা হয়।

ব্যভিচারের শাস্তি বিষয়ক কিছু প্রাথমিক বিধান বর্ণিত হয়। প্রকৃত তাওবাহকারীদের আল্লাহ ক্ষমা করেন। তবে যে গুনাহ করতেই থাকে আর মৃত্যু নিকটে আসলে তাওবাহ করে, তাদের কোনো ক্ষমা নেই। স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার ন্যায়ানুগ সম্পর্ক, তালাক দিলে মোহর ফেরত না নেয়া সংক্রান্ত বিধান বর্ণিত হয়। কার কার সাথে বিবাহ সম্পর্ক করা হারাম, তার তালিকা বর্ণিত হয়।

যুদ্ধবন্দিনী কাফির নারীদের সাথে সহবাসের বিধান বর্ণিত হয়। মুসলিম স্বাধীন নারীকে বিবাহের সামর্থ্য না থাকলে দাসীদের বিবাহ করতে বলা হয়। বিবাহকে নিছক আনন্দ সম্ভোগের পথ না বানিয়ে চরিত্রের হেফাজত এবং আল্লাহ মানুষকে বংশবিস্তার ও খিলাফাতের যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা পূর্ণ করার মাধ্যম বানাতে উৎসাহ দেওয়া হয়।

জুলুম করে অন্যের সম্পদ ভোগ করতে নিষেধ করা হয়। কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকলে ছোটখাটো গুনাহগুলো মাফ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

কিছু নারী সাহাবি ইচ্ছা পোষণ করতেন যে পুরুষ হলে তাঁরাও জিহাদের সাওয়াব পেতেন। আল্লাহ যাকে যে বিষয়ের এখতিয়ার দেননি, সে বিষয়ে এরকম কথাবার্তা বলতে নিষেধ করা হয়। প্রত্যেকের দায়িত্ব নিজ নিজ জায়গায় স্বতন্ত্র। নারীদের ওপর পুরুষদের অভিভাবকত্বের স্বরূপ ও পরিসর বর্ণিত হয়। স্বামী-স্ত্রীর কলহ মীমাংসার নিয়ম বর্ণিত হয়।

শির্ক না করা, পিতামাতা, আত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট, দূর, অস্থায়ী প্রতিবেশী, পথচারী ও দাসদাসীদের প্রতি সদাচরণ করা ও অহংকার না করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

কৃপণতা এবং লোকদেখানো দানের ভয়াবহতা বর্ণিত হয়।

হাশরের ময়দানে প্রত্যেক উম্মতের মধ্য থেকে একজন করে সাক্ষী হাজির করা হবে এবং সেই সাক্ষীদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবেন মুহাম্মাদ (সা.)। সেদিন কাফিররা জমিনের সাথে মিশে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করবে।

মদ্যপান করে সালাতের নিকটবর্তী না হতে বলা হয়, যা মদ হারাম করা সংক্রান্ত প্রাথমিক পর্যায়ের একটি আয়াত। তায়াম্মুমের বিধান বর্ণিত হয়।

আহলে কিতাবদের কিতাব বিকৃতি, দ্ব্যর্থবোধক কথা বলা ও শির্ক করার স্বভাবকে তিরস্কার করা হয়।

আত্মপ্রশংসা এবং নিজেকে ক্রটিমুক্ত মনে করা বৈধ নয়। ইয়াহুদীরা নিজেদেরকে পবিত্র বলে বর্ণনা করত। আল্লাহ তা’আলা আয়াত নাযিল করে এমন আচরণের নিন্দা করেছেন।

আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও উলিল আমর (মুসলিমদের দায়িত্বশীল নেতা) এর আনুগত্য করতে বলা হয়। আমানতদার হওয়া এবং কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী বিচার ফায়সালা করার হুকুম করা হয়। ঈমান আনার দাবি করার পরও তাগুতের কাছে বিচার ফায়সালা চাওয়াকে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বিচার ফায়সালার ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথাই মানতে হবে। পূর্বেকার উম্মতদের অনেক কঠিন বিধান মানতে হত (যেমন তাওবাহর অংশ হিসেবে পরস্পরকে হত্যা করা), অথচ আমাদের জন্য তা সহজ করা হয়েছে।

অত্যাচারিত দুর্বল নারী, পুরুষ ও শিশুদের পক্ষ হয়ে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়। মুনাফিকরা এ ইবাদত থেকে দূরে থাকে। মুমিনদের বিপদে পড়তে দেখলে তারা খুশি হয় আর বিজয় পেতে দেখলে আফসোস করে।

মাক্কী যুগে অত্যাচারিত হয়ে মুসলিমরা আশা করত যাতে যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু তখন এ বিধান দিলে তা কেবল ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার প্রতিফলন হতো। আজ মাদানী যুগে জীবনে নিরাপত্তা আসার পর আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের বিধান নাযিল হলে অনেকে আতংকিত হয়ে ভাবে “হায়! আর কিছু দিন পরে কেন নাযিল হলো না!”

মৃত্যু তো একদিন আসবেই। তাই মৃত্যুভয়ে আল্লাহর বিধান পালনে পিছপা না হতে বলা হয়।

কল্যাণ-অকল্যাণ আল্লাহর তরফ থেকেই আসে। তবে মানুষ নি’আমত পায় আল্লাহর অনুগ্রহে আর বিপদে পড়ে নিজ কৃতকর্মের দরুণ।

গভীরভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে, সামান্যতম ত্রুটিমুক্ত কুরআন আল্লাহরই নাযিলকৃত কিতাব।

যাচাই না করে গুজব ছড়ানোকে তিরস্কার করা হয়।

সালামের জবাব দেওয়ার উত্তম নিয়ম আলোচিত হয়।