১৭। সূরা বনী ইসরাইল

সূরা বনী ইসরাইলের শুরুতে ইসরা-মিরাজের ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহর ক্ষমতা এমনই যে তিনি তাঁর বান্দাকে এক রাতের কিছু অংশে এতদূর ভ্রমণ করান।

বনী ইসরাইল তাদেরই বংশধর যারা নূহ (আঃ) এর সাথে নৌকায় ছিল। অথচ তারা নূহের মতো শোকরগুজার না হয়ে ফাসাদ সৃষ্টিকারী হয়েছে। এর ফলে তাদের ওপর দুইবার দুইজন প্রতাপশালী জালিম শাসক চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। শেষ নবীর (সাঃ) প্রতি ঈমান না এনে আবারও ফাসাদ করলে আবারও একই পরিণতি হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়।

যেভাবে কল্যাণ চাওয়ার কথা, সেভাবে কাফিররা দ্রুত আযাব দেখতে চায় নিদর্শন হিসেবে। অথচ সৃষ্টিজগতেই হাজারো নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। দুনিয়ার রিযিক মুমিন-কাফির সকলের জন্য উন্মুক্ত, আর আখিরাত শুধু মুমিনদের জন্য। তাই দুনিয়াবি প্রাচুর্য থাকা মানেই হকপন্থী হওয়া নয়।

পিতামাতা, আত্মীয়, মুসাফির, অভাবী, ইয়াতীমের হক আদায়, কৃপণতা ও অপচয়ের মাঝামাঝি পথ অবলম্বন, ব্যভিচারের নিকটে না যাওয়া, লোক না ঠকানো, অন্যায় হত্যা না করা, যাচাই না করে গুজব না ছড়ানো, অহংকার না করা, সর্বোপরি তাওহীদ আঁকড়ে ধরার হুকুম বর্ণিত হয়।

একাধিক ইলাহ থাকলে তারা পরস্পর দ্বন্দ্বে জড়িয়ে জগত বিশৃঙ্খল করে দিত।

প্রথমবার যিনি সৃষ্টি করেছেন, দ্বিতীয়বার আখিরাতে সৃষ্টি করা তাঁর জন্য কঠিন কিছু নয়।

উত্তম কথা বলার হুকুম করা হয়। শয়তান খারাপ কথার মাধ্যমে ঝগড়া বিবাদ লাগায়।

মুশরিকরা কিছু জিন ও ফেরেশতাকে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছিল। অথচ এসকল মাখলুক নিজেরাই আল্লাহর অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী।

পূর্বেকার জাতিসমূহ স্পষ্ট মু’জিযা দেখেও কুফরি করে আযাব তরান্বিত করত। যেমন সামুদ জাতি পাহাড় থেকে বের হওয়া উটনী দেখেও সোজা হয়নি।

আদম (আঃ) এর সৃষ্টি ও তাকে সেজদা করতে অবাধ্য ইবলীসের অহংকারের ঘটনা বিধৃত হয়। ফলে শয়তান অঙ্গীকার করে মানুষকে পথভ্রষ্ট করার। তাকে কিয়ামাত পর্যন্ত আয়ু দিয়ে তার সকল বাহিনী নিয়ে চেষ্টা করার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু আল্লাহর খাঁটি বান্দাদের তিনি নিজেই রক্ষা করবেন।

বিপদে পড়লে মানুষ সব উপাস্য ভুলে কীভাবে আল্লাহকে ডাকে, উদ্ধার পাওয়ার পর আবার কীভাবে শির্কে লিপ্ত হয়, তা নৌযানে সফরকালীন ঝড়ের উদাহরণ দিয়ে বোঝানো হয়েছে।

আখিরাতের বিচারে কারো প্রতি জুলুম করা হবে না।

নানাবিধ প্ররোচনার পরেও রাসূল (সাঃ)কে পথচ্যুত করতে ব্যর্থ হয়ে পূর্ববর্তী নবীদের শত্রুদের মতোই মক্কার মুশরিকরাও ফিকিরে আছে রাসূলকে (সাঃ) এখান থেকে বের করে দেবে। অথচ এমনটা করার পর নবীর শত্রুরা নিজেরাও বেশিদিন নিজ জনপদে থাকতে পারে না। বাস্তবেও মক্কার মুশরিকদের এই পরিণতিই হয়েছিল।

পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও তাহাজ্জুদের গুরুত্ব বর্ণিত হয়।

সত্য সমাগত, মিথ্যা দূরীভূত। কুরআন মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও হিদায়াত। আর জালিমদের এর দ্বারা ক্ষতিই বৃদ্ধি পায়।

রাসূলকে (সাঃ) রুহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। আল্লাহ জানিয়ে দেন রুহ হলো আল্লাহর হুকুম, যার বিস্তারিত জ্ঞান মানুষকে দেয়া হয়নি।

মু’জিযা দেখতে চেয়ে কাফিররা যেসব আজগুবি দাবি করে সেগুলো খণ্ডন করা হয়েছে। নবী কেন ফেরেশতা না হয়ে মানুষ হলো এ নিয়েও তারা আপত্তি তোলে। এছাড়া এরা এত কৃপণ যে, আল্লাহর রহমতের ভাণ্ডার এদের হাতে থাকলেও তারা খরচ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কৃপণতা করত। জাহান্নামে এদের জন্য নির্ধারিত আযাবের বর্ণনা দেয়া হয়।

মূসা (আঃ) এর কওমের বিরুদ্ধে ফিরআউনের ষড়যন্ত্র ও এর পরিণতি বর্ণিত হয়।

কুরআনকে অল্প অল্প করে নাযিল করার হেকমত বর্ণিত হয়।

জ্ঞানীরা কুরআন শুনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে রবের প্রশংসা ঘোষণা করে ও বিনয়ী হয়।

সালাতে মধ্যম স্বরে কুরআন তিলাওয়াত করতে বলা হয়। আল্লাহর আসমাউল হুসনা সম্পর্কে বলা হয়।

১৮। সূরা কাহফ, আয়াত ১ থেকে ৭৪

সূরা কাহফে চারটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যা জীবনমরণ, সম্পদ, জ্ঞান ও ক্ষমতা সংক্রান্ত বিষয়ে আল্লাহর ওপর ঈমান রাখা বিষয়ক। উল্লেখ্য দাজ্জাল এসকল বিষয়েই ফিতনা ছড়াবে।

প্রথম ঘটনাটি গুহাবাসী যুবকদের বা আসহাবুল কাহফের। তারা ছিল বিশুদ্ধ তাওহীদবাদী। কিন্তু তারা যে রাজ্যে থাকত, তার বাদশাহ ও জনগণ ছিল মুশরিক। তাদের পক্ষ থেকে অত্যাচার ও কুফরের দাওয়াতের ভয় ছিল। যুবকেরা এই সমাজের সাথে কোনো আপোষ না করে একটি গুহায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। তাদের সাথে তাদের এক কুকুর ছিল। সেই গুহার ভেতর আল্লাহ তাদের ঘুম পাড়িয়ে দেন আর কুকুরটি পাহারার ভঙ্গিতে গুহামুখে বসে থাকে। এ অবস্থায় ৩০০ বা তারও বেশি বছর (প্রকৃত সময়সীমা আল্লাহই জানেন) পেরিয়ে যায়। এরপর তারা জেগে উঠে অনুমান করার চেষ্টা করে তারা কতদিন ঘুমিয়ে ছিল। তাদের মধ্যকার একজনকে কিছু টাকা দিয়ে তারা সাবধানে কোথাও থেকে হালাল খাবার আনতে পাঠায়। ততদিনে সেই এলাকায় তাওহীদপন্থী সাচ্চা ঈমানদার বাদশাহ ও জনপদ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এবং তারা বহু বছর আগে এই যুবকদের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা জানত। খাবার কিনতে আসা যুবকের কাছে শতশত বছর আগের মুদ্রা দেখে সব কাহিনী খোলাসা হয়ে যায়। এতে ঐসকল যুবক ও জনপদের লোকেদের উভয় পক্ষের ঈমান বেড়ে যায়। এর অল্পসময় পরেই যুবকেরা মারা যায় এবং জনপদের লোকেরা তাদের অত্যন্ত সম্মান দেখায়। জীবন দিয়ে হলেও কুফরের সাথে আপোষ না করা এবং আখিরাতের পুনরুত্থানের একটি নমুনা এখান থেকে জানা যায়। কিন্তু যাদের মূল শিক্ষার দিকে ঝোঁক নেই, তারা যুবকদের সংখ্যা, কুকুরের গায়ের রং, গুহায় অবস্থানকাল  ইত্যাদি নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত হবে।

কাফিররা মুহাম্মাদ (সাঃ) এর অনুসারীদের মাঝে গরীব লোকদের দেখে বলত এদেরকে সরিয়ে তাদের মতো সম্ভ্রান্তদের জায়গা করে দিতে। তাহলে তারা ঈমান আনবে। আল্লাহ দুই ব্যক্তির ঘটনার উপমা দেন। একজনের দুটি উর্বর বাগান ছিল। সে নিজ সম্পদ নিয়ে অহংকার করত, আখিরাত অস্বীকার করত। অপরজন তাকে অহংকার ত্যাগ করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে বলে, অন্যথায় কোনো আযাব চলে আসতে পারে। এমতাবস্থায় একদিন কোনো এক দুর্যোগ এসে ওই অহংকারীর সব ফসল নষ্ট করে ফেলে। মুমিন-কাফির উভয়ই দুনিয়ায় কিছু না কিছু রিযক পায়। কিন্তু আখিরাতে কাফিরের সব উপার্জন এভাবে নিষ্ফল হয়ে যাবে। নিজ আমলনামা দেখে গুনাহহাররা ভাববে হায় এ কেমন আমলনামা! এ যে ছোট বড় কোনো কিছুই বাদ দেয়নি। আদমকে সিজদা না করা জ্বীন ইবলিসের অনুসারী এবং মুশরিকদের জন্য আছে শুধুই আগুন।

রাসূলদের আনিত বিধানের বিপক্ষে কাফিররা বাতিল দ্বারা তর্ক করে। আল্লাহর আয়াত স্মরণ করিয়ে দেয়ার পরও তা থেকে যারা বিমুখ হয় তারাই সর্বাধিক জালিম। প্রতিশ্রুত সময়ে তারা অবশ্যই আযাবপ্রাপ্ত হবে। মূসা (আঃ)-কে একবার এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেছিল সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি কে। সংশ্লিষ্ট যুগের নবীর চেয়ে যেহেতু কারো জ্ঞান বেশি হয় না, তাই সেটা ভেবে মূসা (আঃ) অহংকার ছাড়াই জবাব দেন যে তিনিই সবচেয়ে জ্ঞানী। এ উত্তর আল্লাহর পছন্দ না হওয়ায় তিনি মূসা (আঃ)-কে তাঁর আরেক জ্ঞানী বান্দা খাযির (আঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করাতে চান। মূসা (আঃ) জ্ঞান লাভের আগ্রহে সেদিকে যাত্রা করেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন ইউশা (আঃ)। কথা ছিল তাঁদের সঙ্গে থাকা মাছ যেখানে হারিয়ে যাবে, সেখানেই খাযির (আঃ) এর দেখা পাওয়া যাবে। এক জায়গায় তাঁরা বিশ্রাম নিতে গেলে মাছটি সমুদ্রে সুড়ঙ্গ মতো পথ করে চলে যায়। ইউশা (আঃ) এ কথা মূসা (আঃ)-কে বলতে ভুলে যান। সামনে কিছুদূর পথ চলার পর মূসার (আঃ) ক্ষিদে পায়। সেসময় ইউশা (আঃ) এর সেই মাছের কাণ্ড মনে পড়ে। মূসা (আঃ) বুঝতে পারেন কাঙ্ক্ষিত জায়গা তাঁরা ফেলে এসেছেন। সেখানে ফিরে গিয়ে তাঁরা খাযির (আঃ) এর দেখা পান। মূসা (আঃ) জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর সঙ্গী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। খাযির (আঃ) বললেন যে মূসা (আঃ) তাঁর সাথে ধৈর্য ধরে থাকতে পারবেন না। মূসা (আঃ) ধৈর্য ধরার প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁরা একসাথে চলতে শুরু করেন। তাঁরা একটি নৌকায় কিছু পথ যান। খাযির (আঃ) নৌকাটি ফুটো করে দেন। কিছুদূর গিয়ে তিনি একটি বালককে হত্যা করেন। উভয় ঘটনায়ই মূসা (আঃ) ধৈর্য হারিয়ে প্রশ্ন করে বসেন। ঘটনার বাকি অংশ পরের তারাবীহতে আসছে ইনশাআল্লাহ।